সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইর মোহসেনাতে থাকেন হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের তাজুল ইসলাম। গত ১৫ দিন ধরে এক দুয়ার থেকে অন্য দুয়ারে হন্যে হয়ে ঘুরছেন একটা পাসপোর্টের জন্য। ৫ বছর আগে কাজ নেই এমন অজুহাতে কোম্পানি তাকে চাকরিচ্যুত করে পাঠিয়ে দিতে চায় দেশে।
কিন্তু চড়া অভিবাসন ব্যয়ের দেনা, পরিবারের ভরণপোষণের দায় তাকে অবৈধ হয়ে থাকতে বাধ্য করে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তাজুল বলেন, “৫/৬ বছর দেশে যাই না, কিন্তু প্রতিমাসে দেশে ৬০ হাজার টাকা পাঠাই। সংসার চলে নিজে চলি। আরবরা আমাদেরকে সাপোর্ট করে, কিন্তু নিজের দেশের কনস্যুলেটে গেলে উনারা আমাদের চেনেন না, জানেন না। ভাই আমরা তো একই দেশের মানুষ, আমাদের সঙ্গে দূতাবাস বা কন্সুলেটে একটু কোমল ব্যবহার করলে কী হয়?”
খোঁজ নিয়ে দেখা যায় তাজুল ইসলামের কাছে মেয়াদোত্তীর্ণ আমিরাত আইডি’র কপি আছে, জন্ম সনদ আছে, আমিরাত অভিবাসন দপ্তরের ছাড়পত্র আছে। কিন্তু তার পুরনো পাসপোর্টের কপি নেই। এ জন্য বারবার দুবাই কনস্যুলেট থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার পাসপোর্ট হবে না। বিনা জেল জরিমানায় দেশে ফিরে যাওয়ার কিংবা আমিরাতে অবৈধ অভিবাসী তার নিজের অবস্থান বৈধ করার জন্য আরব আমিরাত সরকার ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার অর্ধেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে, আর তাতে উৎকণ্ঠা বাড়ছে তাজুলদের। বলেন, “পাসপোর্টটা হলে আরব স্পন্সর আছেন আমাকে ভিসা দেয়ার জন্য, ভিসা লাগিয়ে দেশে ঘুরে আসতাম!”
বৈধ হয়ে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চান চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার জাহাঙ্গীর আলম, তিনি ৬ বছর আগে আমিরাতে এসেছেন। একটি ভারতীয় মালিকানাধীন নির্মাণ কোম্পানিতে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতেন। কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে ৪ বছর আগে বন্ধ হয়ে যায়, অবৈধ হয়ে পড়েন তিনি। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পর তিনি ইমিগ্রেশনে গেলে জানতে পারেন যে তার পাসপোর্ট ব্যবহার করে এরই মধ্যে একজন দেশে চলে গেছেন। বিপাকে পড়েছেন তিনি। হন্যে হয়ে ঘুরছেন এই দুয়ার থেকে ওই দুয়ারে সাহায্যের আশায়। কী করবেন জানেন না, আউটপাশ নিয়ে শেষমেশ তার দেশে ফেরার একটা সুযোগ হয়ত তার হবে, কিন্তু যে ভুল তিনি করেননি তার মাশুল তাকে দিতে হবে।
সিলেটের হবিগঞ্জের তাজুল ইসলাম, আল আইনে আছেন। এক আরবের খামারে উট-ছাগল-বকরির যত্ন পরিচর্যার কাজ করেন। দুবছর ওমানে ছিলেন। কাজকর্ম নেই, তাই এক বছরে আগে অবৈধ পথে আমিরাত এসেছেন। যে আরবের খামারে কাজ করেন তিনি ভিসা লাগাতে সম্মত আছেন, কিন্তু তার কাছে পাসপোর্ট কপি নেই। তাই তার পাসপোর্ট হচ্ছে না। আবার হয়তো এজন্য সুযোগ আসলেও অবৈধ হয়ে পড়তে হবে, সে আতংকে তার দিন কাটছে।
শারজাহ ন্যাশনাল পেইন্টস এলাকায় থাকেন টাঙ্গাইল নিউ বাসস্ট্যান্ড এলাকার মোহাম্মদ আলিম। ফুডস্টাফ ট্রেডিং এর ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, “দুবাই কন্সুলেটের লোকজন প্রবাসীদেরকে এত পেইন দিচ্ছে যা বলার মতো না। আউটপাস নিতে গেছি, আমাকে আক্রমন করে বললেন, এতদিন ঘোড়ার ঘাস কাটছিলেন, এখন আসলেন কেন? তাহশিল অফিসে যখন যাই তখন ওরা আরবি না বুঝলে ইংরেজিতে, ইংরেজি না বুঝলে হাতে-কলমে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু যখন দূতাবাস বা কনস্যুলেটে যাই তখন ধমকের সুরে বলা হয়, ‘মিয়া অবৈধ হইছেন কেনো?’ অবৈধ তো আমরা এমনি এমনি হইনি, পরিস্থিতির কারণে হয়েছি। আমিরাত সরকার যারা অবৈধ হয়েছেন তাদের যেখানে লাখ লাখ দিরহাম জরিমানা মওকুফ করতে পেরেছেন, সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দিয়েছেন, সেখানে নিজের দেশের লোক হয়েও তারা আমাদের সঙ্গে সামান্য ভাল ব্যবহারটাও করছেন না।”
শারজাহ প্রবাসী কক্সবাজারের রামুর বাসিন্দা শামসুল আলম। ২০১১ সাল থেকে অবৈধ হয়ে আছেন। জানালেন তার ডিজিটাল পাসপোর্ট নম্বর আছে, তাহশিল অফিস থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন, কিন্তু পাসপোর্ট কপি না থাকার কারণে তাকে বারবার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, “আঁরা দে খষ্টত আছি, তারা হিয়ান ন বুজের, এক সপ্তা ফরি আছিলাম উয়া রোইদুর মইধ্যে, খাম নঅ হয়। তারা ওয়া আঁরারে মানুষ মনে ন গরে!”
২০১২ সালের মধ্য অগাস্ট থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত দেশটিতে চাহিদার অতিরিক্ত অদক্ষ বাংলাদেশি শ্রমজীবির অনুপ্রবেশ, ভিসা জালিয়াতিসহ নানা অপরাধকর্মে অধিক হারে বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্টতার কারণ বাংলাদেশিদের সব ধরণের ভিসা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় বাংলাদেশিদের জন্য আভ্যন্তরীণ ভিসা ট্রান্সফারও। দুর্বল ও শ্লথগতির ভিসা ডিপ্লোমেসি ও বিভিন্ন টানাপোড়েনে দীর্ঘ ৬ বছরের বেশি সময়ে ভিসার জট না খোলায় আমিরাতে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজারটি মুখ থুবড়ে পড়ে।
চাকরি হারিয়ে অনেকেই দেশে ফিরে যান, আবার ভিসা খোলার আশায় কেউ কেউ অবৈধ হয়ে পড়েন। চড়ামূল্যে আরব্য গৃহকর্মী কিংবা বিজনেস পার্টনার ভিসায় অনেকে কোনমতে তাদের অবস্থানের বৈধতা ধরে রাখেন।
গত ১ অগাস্ট থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে চলা ৩ মাসব্যাপী অ্যামনেস্টি বা সাধারণ ক্ষমার সময় চলছে। এর আওতায় দেশটিতে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসীদের বিনা জেল-জরিমানায় আমিরাত ত্যাগের কিংবা দেশটিতে তাদের অবস্থান বৈধ করার সুযোগ তৈরি হয় যা অনেকের জন্যই স্বস্তির সংবাদ হয়। ধারণা করা হয় যে বৈধভাবে এদেশে এসেও বিভিন্ন কারণে অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের সংখ্যা ১০ শতাংশ। বৈধ হতে কিংবা বিনা জেল জরিমানায় আমিরাত ত্যাগে ইচ্ছুক এ অবৈধ বাংলাদেশিদের ভিড়ে সীমিত জনবল নিয়ে থাকা আবুধাবি দূতাবাস ও দুবাই কনস্যুলেটের নাকাল অবস্থা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপমহাদেশের অন্যান্য দেশ যাদের জনশক্তি এদেশে বেশি তারা পুরো ব্যবস্থাকে অনেকটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে এসেছেন। ১ অগাস্ট থেকে আবুধাবি দূতাবাসে ২-৩ হাজার সেবাপ্রত্যাশী এবং দুবাই কন্স্যুলেটে তার দ্বিগুণ সংখ্যক প্রবাসী ভিড় করছেন নানা সমস্যা নিয়ে। দূতাবাস তাদের নিয়মিত কন্স্যুলার সার্ভিসের পাশাপাশি এ বিশাল সেবাপ্রত্যাশীদের চাপ মোকাবেলায় ছুটির দিনসহ প্রতিদিন ১০/১২ ঘণ্টা করে কাজ করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার উপর রয়েছে দূতাবাস ও দুবাই কন্সুলেটের এক শ্রেণির কর্মচারীর বিমাতাসুলভ আচরণ যার প্রমাণ উপরের অভিযোগগুলো। এছাড়া অর্থলিপ্সু দালালদের প্রলোভনে পড়ে অনেকেই গুনছেন লোকসান।
এ ব্যাপারে দেশটিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে
বলেন, “সংখ্যাগত দিক থেকে দুবাই কনস্যুলেটে সাধারণ ক্ষমার সেবাপ্রার্থীরা বেশি যান, আমরা চেষ্টা করছি সেখানে সেবার মান আরো উন্নত করার জন্য। আবুধাবি দূতাবাসের সেবার মান বৃদ্ধির বিষয়েও আমরা সচেতন আছি।“
তিনি বলেন, “অবৈধ অভিবাসীরা তাদের যে কোনো সমস্যা নিয়ে আমাদের কাছে আসুন, আমরা তা দেখে সমাধানের চেষ্টা করব। কারো পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে, কারো পুরনো হাতে লেখা পাসপোর্ট যার যা সমস্যা আছে আসুন, আমরা স্থানীয়ভাবে তার সমাধানের চেষ্টা করব, না পারলে ঢাকায় পাসপোর্ট ও বহিরাগমন দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার সমাধানের চেষ্টা করব।”
তিনি জানান, এখন পর্যন্ত আবুধাবি দূতাবাস ও দুবাই কনস্যুলেট থেকে ১২ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে এমআরপি সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে এবং প্রায় ২ হাজার অভিবাসীকে দেশে ফিরে যাবার জন্য আউটপাশ দেওয়া হয়েছে।
দালালচক্রের হয়রানি বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা এদের আগেও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দিয়েছি, কিন্তু দূতাবাসের বাইরে এদের তৎপরতা নিয়ে আমাদের খুব বেশি করণীয়ও থাকে না।“
আরব আমিরাতের শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়- ১৯৯৬, ২০০২, ২০০৭ ও ২০১৩ সালে পরিচালিত চারটি সাধারণ ক্ষমার আওতায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ৯ লাখেরও বেশি অবৈধ অভিবাসী সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়েন কিংবা এদেশে তাদের অবস্থান বৈধ করে নেন।
সূত্র, বিডিনিউজ২৪.কম